প্রাথমিক শিক্ষায় সংসদ টিভি ও অনলাইন ক্লাসের কার্যকারিতা এবং প্যানেলের যৌক্তিকতা News Publisher News Publisher প্রকাশিত: ১:৫২ অপরাহ্ণ, জুন ৮, ২০২০ পরশ রহমানঃ এই করোনাকালে শিক্ষার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে সেগুলো আসলে কতটা কার্যকর সে বিষয়ে কিছু বলতে চাই। সংসদ টিভিতে শিক্ষার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে প্রাথমিকের ক্লাস করানো হচ্ছে, এ করোনাকালে এমন উদ্যোগের অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার সরকার এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিন্তু সংসদ টিভির ক্লাসগুলো কতটা কার্যকর এবং তা কোমলমতি শিশুরা কতটা গ্রহণ করছে সেটাও দেখার বিষয়। এটার জন্য আমাদের কোটি কোটি টাকা খরচ করে জরিপ করে তথ্য নেয়ার দরকার নেই। আমাদের প্রত্যেকের বাড়িতে বা আমাদের আশেপাশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দিকে তাকালেই আমরা বুঝে নিতে পারি। যেমন আমাদের বাড়ির উদাহরণ দেই- আমাদের বাড়িতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে ৬টি শিশু। তাদের মধ্যে তিনজনের ঘরে টিভি নেই। এ তিনজন তাহলে সংসদ টিভির ক্লাসের আওতার বাইরে। বাকি তিনজনের পরিবারের গার্ডিয়ানদের অসচেতনতার জন্য, শিশুদের ফাঁকিবাজি মনোভাবের জন্য, নিকলোডিয়ান চ্যানেলে কার্টুন দেখার প্রবণতার জন্য শিশুরা সংসদ টিভি না দেখে কার্টুনের চ্যানেল দেখে। আবার দেখা যায় কোনো কোনো সময় গার্ডিয়ানরা সিরিয়াল দেখে বা খবর দেখে কিংবা ফিল্ম দেখে। সংসদ টিভি চ্যানেলে যে শিশুদের ক্লাস হয় এটা আবার অনেক গার্ডিয়ান এখনো জানেও না। আর যারা জানে তারা এটা জানে না, কোন সময় কোন শ্রেণির ক্লাস হবে? এসব কারণে আমার কাছে মনে হয় সংসদ টিভির ক্লাসগুলো প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে তেমন কার্যকর নয়। আমার ভাগনী এবার ক্লাস ফাইভে পড়ে চট্টগ্রাম সিটি গার্লস সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। আমার বোন এবং ভগ্নিপতি তাদের মেয়ের শিক্ষার ব্যপারে খুবই সচেতন। কিছুদিন আগে আমি ফোন করে সংসদ টিভির ক্লাস সম্পর্কে বোন এবং ভাগনীকে অবগত করেছিলাম। তখন তারা অভিযোগের সুরে বললো যে, ক. সংসদ টিভিতে একই ক্লাস বারবার দেখায় মানে পুনঃপ্রচার করা হয় বারবার। যেটা ভাগনীর কাছে এবং আমার বোনের কাছে বিরক্তিকর লাগে। তাই প্রথম দিকে ভাগনী সংসদ টিভির দু চারটা ক্লাস দেখলেও এখন রিমোট দিয়ে সংসদ টিভি ঘুরেও দেখেনা! খ. সংসদ টিভির ক্লাসগুলো মাত্র ২০ মিনিটের। এ কারণে শিক্ষকরা অতি দ্রুত টপিকগুলো আলোচনা করে সামনে এগিয়ে যান। অথচ শিশু শিক্ষার টপিকগুলো ধীরে ধীরে সময় নিয়ে আলোচনা করতে হয়। অতি দ্রুত আলোচনার ফলে অনেককিছু বুঝতে পারেনা বলে আমার ভাগনী সংসদ টিভির ক্লাসগুলো দেখে না। গ. শিশু শিক্ষা বা প্রাথমিক শিক্ষা শিক্ষকের প্রত্যক্ষ তত্ত্ববধান ছাড়া অসম্ভব। যেসব শিশুরা অতি দূর্বল তারা সংসদ টিভির ক্লাসগুলো বুঝে না। কারণ দূর্বল ছাত্র ছাত্রীদের ভালো করে সময় নিয়ে বুঝাতে হয়, একই কথা বারবার বলতে হয়, যেটা সংসদ টিভির ক্লাসগুলোতে দেখা যায় না। . এবার অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম নিয়ে কিছু বলতে চাই– কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশির ভাগ শিক্ষার্থীদের নিজেদের একটি এ্যান্ড্রুয়েড মোবাইল থাকে এবং তারা জানে কীভাবে ইন্টারনেটে প্রবেশ করতে হয়, কোন এ্যাপসের মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে হয়, কীভাবে মোবাইলে থ্রিজি বা ফোরজি সেটিং করতে হয় ইত্যাদি মৌলিক বিষয়গুলো তারা জানে। আবার কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নিজেরাই নিজেদের শিক্ষার ক্ষেত্রে সচেতন। আত্ম-সচেতনতা এবং নিজেদের এ্যান্ড্রুয়েড মোবাইল থাকার কারণে অনলাইনভিত্তিক ক্লাসগুলো কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে কিছুটা সফলতা পেলেও প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরে কার্যকর নয় বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষাস্তরেতো নয়ই। কেননা প্রাথমিকের শিশুদের অনলাইনভিত্তিক ক্লাসে যোগ দিতে হলে সম্পূর্ণ তাদের অভিভাবকদের উপর নির্ভরশীল হতে হয়। এখন এখানেও কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সেগুলো মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- ক. অধিকাংশ অভিভাবকদের এ্যান্ড্রুয়েড ফোন নেই। ফলে অনলাইনে ক্লাস দেখা অসম্ভব। খ. যেসব অভিভাবকদের এ্যান্ড্রুয়েড মোবাইল আছে তাদের মধ্যে আবার অধিকাংশ অভিভাবক অশিক্ষিত ও অসচেতন এবং তারা ইন্টারনেট ব্যবহার সম্পর্কে জানেনা। ফলে অনলাইনভিত্তিক ক্লাসে তারা যুক্ত হতে পারছে না। গ. এখন ধরুন অভিভাবক শিক্ষিত ও সচেতন, ইন্টারনেটের ব্যবহার সম্পর্কে জানে। এ ধরনের অভিভাবকদের ক্ষেত্রে একটা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সেটা হলো- ইন্টারনেটের স্পিড কম থাকা, ইন্টারনেটের সংযোগ না থাকা, নেটওয়ার্ক সমস্যা ইত্যাদি কারণে তাদের অধিকাংশ আবার অনলাইন ক্লাস থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। . সুতরাং দেখা যাচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের বড় একটা অংশ সংসদ টিভি ও অনলাইনভিত্তিক ক্লাস থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। মোটের উপর ১০ থেকে ১৫ শতাংশ মেধাবী শিক্ষার্থী সংসদ টিভি ও অনলাইনভিত্তিক ক্লাসের সুফল পাচ্ছে। . তাই বলা যায়, প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম শিক্ষকের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধান ছাড়া অসম্ভব। সেজন্য প্রতিটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক সংকট থাকাটাও সমীচীন নয়। কারণ এতে শিশুদের মেধা বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে, আমাদের দেশে বছরব্যাপী প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক সংকট লেগেই থাকে। তার কারণ প্রতিদিন পদ শূন্য হলেও নিয়োগ দেয়া হয় না। আর প্রতিদিন নিয়োগ দেয়া সম্ভবও না। আবার একটা নিয়োগ কার্যক্রম শেষ করতে দেড় থেকে দু’বছর লেগে যায়। এজন্য প্রাথমিকে প্যানেলের মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার যৌক্তিকতা রয়েছে। তাই প্রাথমিক সহকারি শিক্ষক নিয়োগ ২০১৮ এর লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ বাকি ৩৭০০০ প্রার্থীকে প্যানেলের মাধ্যমে প্রাথমিকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দানের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন জানাচ্ছি। এতে করে যেমন করোনা পরবর্তী সময়ে দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক সংকট দ্রুত দূর করা সম্ভব হয় তেমনি প্রাথমিক শিক্ষাক্ষেত্রে গতি ফিরে আসবে। লেখকঃ পরশ রহমান (প্রাথমিক সহকারি শিক্ষক নিয়োগ ২০১৮ এর প্যানেল প্রত্যাশী) SHARES মতামত বিষয়: