বাড়ছে না ছুটি, ঢাকার সামনে কী অপেক্ষা করছে?

প্রকাশিত: ১:৫১ পূর্বাহ্ণ, মে ২৯, ২০২০

করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে সাধারণ ছুটি আর বাড়ছে না। আগামী ৩১ মে থেকে ১৫ জুন পর্যন্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত আকারে অফিস করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আগামী ১৫ জুন পর্যন্ত বন্ধ থাকবে। এই সিদ্ধান্তের ফলে ভাইরাসের সংক্রমণে কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে। এর আগে শিথিলতার কারণে অসচেতন যাতায়াতের পরিমাণ বেড়ে যায়, ফলে বাড়ে সংক্রমণের মাত্রাও। ৪ এপ্রিল পোশাক কারখানা খোলা নিয়ে বিভ্রান্তির কারণে পোশাক শ্রমিকদের ঢাকায় আসা এবং ফিরে যাওয়ার ফলে টেস্ট অনুপাতে সংক্রমণের হার ৪.৬ শতাংশ থেকে এক লাফে বেড়ে যায় ১২.৫ শতাংশে। এরপর ২৬ এপ্রিল সীমিত পরিসরে অফিস ও পোশাক কারখানা খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হলে আবারও সংক্রমণ বাড়ার আভাস পাওয়া যায়। এরপর ১০ মে মার্কেট ও শপিং মল খুলে দেওয়া হলে টেস্ট অনুপাতে শনাক্তের হার গিয়ে পৌঁছায় ২০ শতাংশে।

বাংলাদেশে মোট আক্রান্তের বেশিরভাগ যেহেতু ঢাকা শহরে, তাই সাধারণ ছুটি না থাকার ফলে মানুষের চলাচলের মাত্রা ব্যাপক হারে বেড়ে যাবে। একইভাবে বাড়বে অসচেতন চলাচলও। ফলে অনুমান করা যায় যে শহরে সংক্রমণ আরও গতি পেতে পারে।

 

সর্বশেষ ২৬ মে’র তথ্যমতে ঢাকার ২০৯টি এলাকায় সংক্রমণ পাওয়া গেছে। এসব এলাকা মিলে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ১৪ হাজার ৩৪৮ জন। তবে, এই ২০৯ এলাকার মধ্যে ১৬৭ এলাকায় আক্রান্তের সংখ্যা এখনও ৫০-এর নিচেই আছে। কেবল ৪২টি এলাকায় আক্রান্তের সংখ্যা ৫০-এর অধিক। এ থেকে বলা যায় ঢাকা শহরে আক্রান্তের মাত্রা এখনও প্রাথমিক পর্যায়েই রয়েছে। মানুষের চলাচল বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শহরে আক্রান্তের সংখ্যা ব্যাপক গতি পাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হবে।

 

২৬ মে অনুযায়ী ঢাকার ১৬টি এলাকায় করোনার সংক্রমণ ১০০ অতিক্রম করেছে। এলাকাগুলোর হচ্ছে মহাখালী, যাত্রাবাড়ি, কাকরাইল, মুগদা, মোহাম্মদপুর, রাজারবাগ, উত্তরা, মগবাজার, তেজগাঁও, লালবাগ, বাবুবাজার, ধানমন্ডি, মালিবাগ, খিলগাঁও, বাড্ডা ও গেন্ডারিয়া।

এসব এলাকার মধ্যে সবচেয়ে দ্রুত সংক্রমণ বাড়ছে মহাখালী, যাত্রাবাড়ি, মোহাম্মদপুর ও মুগদায়। এসব এলাকার মধ্যে সংক্রমণ সবচেয়ে বেশি গতিশীল মহাখালীতে। ২৯ এপ্রিলের পর প্রতি দশ দিনে এই এলাকায় নতুন আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে

ছে ১০০ জন। সর্বশেষ ২৬ মে’র উপাত্ত অনুযায়ী, মহাখালীতে আক্রান্তের সংখ্যা ৩৫৬ জন। আক্রান্তের সংখ্যার দিক থেকে এরপরেই আছে যাত্রাবাড়ি। এই এলাকাটিতে আক্রান্তের সংখ্যা ৩১৫ জন। মুগদা ও মোহাম্মদপুরে ২৫ এপ্রিল আক্রান্তের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৪১ ও ৪৯। ঠিক এক মাস পরে ২৫ মে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় যথাক্রমে ২৯৫ ও ২৮০-তে।

রাজারবাগ ও কাকরাইল এলাকায় আক্রান্তের সংখ্যা অনেক দিন ধরেই বেশ স্থির রয়েছে। ২৬ এপ্রিল তথ্য অনুযায়ী এই দুটি এলাকায় আক্রান্তের সংখ্যা যথাক্রমে ২১৩ ও ২৯৮ জন। রাজারবাগে গত ১৮ দিনে আক্রান্ত বেড়েছে ১৩ জন। কাকরাইলে গত ৯ দিনে আক্রান্তের সংখ্যা একজনও বাড়েনি।

উল্লেখ্য, এই স্থিরতা আসার আগে এই দুটি এলাকাতেই সবচেয়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে করোনা। রাজারবাগের ক্ষেত্রে সংক্রমণ কমে আসার বিষ

য়টি অনুমান করা গেলেও কাকরাইলে ক্ষেত্রে তা বলা কঠিন। কারণ, কাকরাইলে ৯ দিন ধরে আক্রান্তের সংখ্যা একই অঙ্কে আটকে আছে, যা উপাত্তের সীমাবদ্ধতার আভাস দেয়।

উত্তরা, মগবাজার, তেজগাঁও, লালবাগ, বাবুবাজার, ধানমন্ডি, মালিবাগ, খিলগাঁও, বাড্ডা ও গেন্ডারিয়া এলাকায় সংক্রমণের গতি মহাখালী বা যাত্রাবাড়ির মতো দ্রুত নয়। তবে, এসব এলাকায়ও যে সংক্রমণ গুণানুপাতিক হারে বাড়ছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ২৬ মে মোতাবেক এসব এলাকায় আক্রান্তের সংখ্যা যথাক্রমে, উত্তরায় ২৩৭ জন, মগবাজারে ২০৫ জন, তেজগাঁওয়ে ১৮৪ জন, লালবাগে ১৬৪ জন, বাবুবাজারে ১৬১ জন, ধানমন্ডিতে ১৭২ জন, মালিবাগে ১৩১ জন, খিলগাঁওয়ে ১৫১ জন, বাড্ডায় ১২৯ জন ও গেন্ডারিয়ায় ১০৯ জন।

ঢাকার সবচেয়ে সর্বাধিক সংক্রমিত ১৬ এলাকার প্রায় সবক’টিতে শেষ ১০ দিনে সংক্রমণ গতি পেয়েছে। এই সময়ের মধ্যে নতুন আক্রান্তের হিসাবে সংক্রমণ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে মহাখালী, উত্তরা, মগবাজার ও মুগদায়। এই চারটির প্রতিটি এলাকা থেকে শেষ ১০ দিনেই আক্রান্ত বেড়েছে ১০০ জনের বেশি। অন্য এলাকাগুলোর মধ্যে কেবল কাকরাইল ও রাজারবা

গ বাদে সবক’টি এলাকাতেই এই ১০ দিনে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আক্রান্ত বেড়েছে।

কখন গতি বেড়েছে সংক্রমণের

৯ এপ্রিল ঢাকায় সংক্রমিত এলাকা

র সংখ্যা ছিল ৬১টি এবং আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১৯৬ জন। এরপর ২৬ এপ্রিল সংক্রমিত এলাকার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৫৪ এবং আক্রান্তের সংখ্যাও বেড়ে দাঁড়ায় দুই হাজার ৪৮৫ জন। তার ঠিক এক মাস পর অর্থাৎ ২৬ মে ঢাকায় আক্রান্ত এলাকার সংখ্যা ২১০টি এবং এসব এলাকায় আক্রান্তের সংখ্যা ১৪ হাজার ৩৪৮ জন।

উপরোক্ত তথ্য এবং চিত্র ১-এর দিকে তাকালে দেখা যায়, এক একটি শিথিলতার সিদ্ধান্তের পরে শহরে সংক্রমণের গতি বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি বেড়ে যায় ১০ মে পরবর্তী সময়ে, আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে ১৬ মে’র পর থেকে। গড় ইনকিউবেশন পিরিয়ডকে ৬ দিন ধরে নিলে মার্কেট ও শপিং মল খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তের প্রভাব ১৬ মে থেকে পরিলক্ষিত হওয়ার কথা। সেই হিসাবে গত ১০ দিনে সংক্রমণের গতি বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে মার্কেট ও শপিং মল খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তের যোগসূত্রের আভাস পাওয়া যায়।

শহরে দৈনিক নতুন শনাক্তের দিনগুলো এই ১০ দিনের মধ্যেই পড়ে। ১৯, ২০ ও ২২ মে ঢাকা শহরে নতুন শনাক্তের সংখ্যা ছিল সর্বোচ্চ, এই দিনগুলোতে যথাক্রমে ৯৩৯, ১৫০১ ও ১০৮৮ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে। কেবল এই তিন দিনই ন

য়, বরং ১০ মে’র পর থেকেই শহরে দৈনিক নতুন আক্রান্তের সংখ্যা ব্যাপক গতি পেয়েছে। আগের চেয়ে যা কমপক্ষে দ্বিগুণ বেশি। যা সংক্রমণের সঙ্গে ১০ মে পরবর্তী সময়ে মার্কেট ও শপিং মলে মানুষের যাতায়াতের সঙ্গে সম্পর্ককেই পুনরায় সামনে আনে।

এর আগেও একবার এমনটি হয়। ৪ এপ্রিল নানান বিভ্রান্তির কারণে পোশাক শ্রমিকদের ঢাকায় এসে ও চলে যাওয়ার পর ঢাকা শহরসহ পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে সংক্রমণ ব্যাপক মাত্রায় গতি পায়।

আক্রান্তের সংখ্যার ভিত্তিতে সংক্রমিত এলাকার সংখ্যা

 

ঢাকায় এলাকাভিত্তিক সংক্রমণ প্রতিনিয়ত বেড়েই চলছে। ৯ এপ্রিল মোট আক্রান্ত এলাকার সংখ্যা ছিল ৬১টি। এরমধ্যে ৫৬টি এলাকাতেই আক্রান্তের সংখ্যা

ছিল ১০-এর কম। এরপর ২৬ এপ্রিল আক্রান্ত এলাকার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৫৪টি। যেগুলোর মধ্যে ১১০টিতে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১০-এর কম। ৪০টিতে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১০ থেকে ৫০-এর মধ্যে। চারটি এলাকায় আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৫০-এর বেশি। এই পর্যায়ে ঢাকা শহরে এলাকাভিত্তিক আক্রান্তের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ার আভাস পাওয়া যায়। যার বাস্তবায়ন দেখা যায় ১০ মে’র উপাত্তের দিকে তাকালে। এদিন আক্রান্ত এলাকার সংখ্যা পাওয়া যায় ১৮০টি। যেগুলোর মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা ১০-এর কম ছিল ৯২ এলাকায়। ৬৫ এলাকায় আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১০ থেকে ৫০-এর মধ্যে। ৫০ থেকে ৯৯-এর মধ্যে ছিল ১৫টি এলাকায় এবং আক্রান্তের সংখ্যা শতাধিক পৌঁছে যায় ৮টি এলাকায়।

সর্বশেষ ২৬ এপ্রিল আক্রান্ত এলাকার সংখ্যা আরও বেড়ে দাঁড়ায় ২০৯টিতে। যেগুলোর মধ্যে এখনও আক্রান্তের সংখ্যা ১০-এর কম আছে ৯৪টি এলাকায়, ১০ থেকে ৫০-এর মধ্যে আছে ৭৪টি এলাকায়, ৫০ থেকে ৯৯-এর মধ্যে আছে ২৫ এলাকায় এবং ১৬ এলাকায় আক্রান্তের সংখ্যা শতাধিক।

এসব উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়,

ঢাকা শহরে আক্রান্ত এলাকার সংখ্যা প্রতিনিয়ত বেড়েছে এটি যেমন সত্য, ঠিক তেমনিভাবে এটিও সত্য যে বেশিরভাগ এলাকায় এখনও সংক্রমণ গতি পায়নি। অসচেতন চলাচলের পরিমাণ বাড়লে এসব এলাকায়ও সংক্রমণ গতি পাওয়ার আশঙ্কা আছে। বিশেষ করে যে ৯৪ এলাকায় আক্রান্তের সংখ্যা এখনও ১০-এর কম আছে সেগুলোতে সংক্রমণ গতি পেলে বিষয়টি শহরের সার্বিক পরিস্থিতিকে আরও বিগড়ে দিতে পারে।

 

বাংলাদেশ যখন অর্থনীতি চালু করতে যাচ্ছে তখন দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহরটির প্রায় অধিকাংশ স্থানে অবস্থান করছে করোনাভাইরাস। বিশ্লেষণে দেখা যায়, এলাকায় সংক্রমণ ৩০ থেকে ৫০ জনে পৌঁছে গেলে সেটিকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। তাই যেসব এলাকায় আক্রান্তের সংখ্যা এখনও কম আছে সেগুলোতে সংক্রমণ আরও কমিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে। ঢাকা শহরের থানাগুলো ধরে ধরে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। শহরের ম্যাপের দিকে তাকালে দেখা যায় উত্তরাংশে এখনও সংক্রমণ তুলনামূলক কম আছে। ওই অংশে থানাভিত্তিক নীতিমালা তৈরি করে সংক্রমণ

নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। ঢাকার দক্ষিণ অংশে সংক্রমণ ছড়িয়েছে বেশি। এই অংশকে নিয়ে কঠোর ও কার্যকর পরিকল্পনা এখন সময়ের দাবি। এসব এলাকায় হটস্পটগুলোকে চিহ্নিত করে সেগুলোকে কঠোর লকডাউনের আওতায় আনা যেতে পারে। রাজারবাগের ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি সংক্রমণ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেলেও তা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়।
উপাত্তের সীমাবদ্ধতা:
১) আইইডিসিআরের এলাকাভিত্তিক আক্রান্তের তথ্যের সঙ্গে শহরে মোট আক্রান্তের তথ্যের মধ্যে বড় পার্থক্য রয়েছে, যার এলাকাভিত্তিক আক্রান্তের সংখ্যা বাস্তব অবস্থা থেকে কম হতে পারে।

২) মিরপুরের সেক্টরভিত্তিক সংক্রমণের চিত্রের পাশাপাশি উপাত্তে মিরপুরের মোট সংক্রমণ চিত্রও দেখানো হয়েছে। মোট সংক্রমণ চিত্র মোতাবেক মিরপুরে সংক্রমণ শতাধিক। কিন্তু সেক্টরভিত্তিক উপাত্তে কোনও আলাদা সেক্টরে সংক্রমণ শতাধিক পৌঁছায়নি। সেই সঙ্গে সেক্টরভিত্তিক উপাত্তের যোগফলের সঙ্গে মোট সংখ্যার মিল না থাকায় সেক্টরভিত্তিক আক্রান্তের সংখ্যাকেই বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।