যশোরে আম্পানে ক্ষতিগ্রস্তরা এখনো সাহায্য পাননি

প্রকাশিত: ৪:৩৫ অপরাহ্ণ, জুন ১২, ২০২০

হঠাৎ করে আম্পান আইসা টিনের চালডা উড়াইয়া নিয়া গেছে। আমার পায়ের উপর ঘরের বাঁশ পড়ে ব্যাথা পাইছি। কোনো কিছু বুঝে উঠার আগেই আমার ঘরবাড়ি, রান্নাঘর উড়াইয়া নিয়ে যায়। গাছ পড়ে ঘরের আসবাবপত্র অবশিষ্ট কিছুই নেই। আমি আমার ছেলে-পিলে নিয়ে এখনো খোলা আকাশের নিচে আছি। শুনেছি সরকার ক্ষতিগ্রস্তদের টিন দিচ্ছে। কই আমি তো কিছুই পাইনি। ঝড়ের ২১ দিন পার হইয়া গেলেও এক খান টিনও পাইলাম না।’

বৃহস্পতিবার (১১ জুন) দুপুরে জেলা ত্রাণ কর্মকর্তার অফিসের প্রবেশদ্বারে মেঝেতে শুয়ে কান্না কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন ঘূর্ণিঝড় আম্পানে আশ্রয়হীন ক্ষতিগ্রস্ত যশোর সদর উপজেলার চাঁচড়া হঠাৎপাড়া এলাকার ষাটোর্ধ বৃদ্ধা হাজেরা বেগম।

বর্তমানে ঝড়ে লণ্ডভণ্ড চাঁচড়ার হঠাৎপাড়া গ্রামের বৃদ্ধ স্বামী শেখ রায়হার উদ্দীনসহ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করছে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারটি। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও জেলা ত্রাণ কর্মকর্তার অফিসে দিলেও মেলেনি কোনো সহযোগিতা।

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন অফিস সূত্রে জানা গেছে, ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতে যশোরে ১৩ জনের প্রাণহানি হয়েছে। আর ক্ষতিগ্রস্ত সাড়ে পাঁচ লাখ পরিবার। ঘরবাড়ি, ফসল, গাছপালা, কাঁচা পাকা রাস্তা ও বিদ্যুতের খুঁটির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। আঘাতের ২১ দিন পার হলেও সেই ক্ষত কাটিয়ে উঠতে পারেনি জেলার মানুষ। কয়েক হাজার মানুষ এখনো আশ্রয়হীন। বহু এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হয়নি। ক্ষয়ক্ষতি সামালে ঘুরে দাঁড়ানোই মানুষের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মোহাম্মদ ছানোয়ার হোসেনের দাবি, আম্পানের আঘাতে যশোর জেলা ২৮৩ কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে।

ঘূর্ণিঝড় আম্পানে জেলার আট উপজেলায় ক্ষতিগ্রস্ত সাড়ে পাঁচ লাখ পরিবার। এক লাখ ৬৭ হাজার ৫০০ ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে আশ্রয়হীন হয়েছে ৮০ হাজার পরিবার। তাদের মধ্যে মাত্র ৬৯০টি পরিবারকে দেওয়া হচ্ছে সরকারিভাবে টিন, খাদ্য ও আর্থিক সহায়তা। যারা সাহায্যের বাইরে রয়েছেন, তারা চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। সরকারি সাহায্য অপ্রতুলতার কারণে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তরা এ থেকে বঞ্চিত রয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে। স্বজনপ্রীতি ও দলপ্রীতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত অধিকাংশ পরিবার রয়েছে তালিকার বাইরে।

আম্পানের ক্ষত না শুকাতেই ফের কালবৈশাখী ঝড়ের আঘাত আনে যশোরে। ফলে এই দুটি ঝড়ের তা-বে ক্ষতিগ্রস্ত অনেক ঘরবাড়ির এখনও মেরামতের কাজ করছে। ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত গড়ে তিন পরিবারের মধ্যে একটি পরিবারও সরকারি সুবিধা পাচ্ছে না। এসব পরিবারের ঘরে ঘরে দেখা দিয়েছে অভাব। বিশেষ করে বিশ্বব্যাপী করোনাকালে অনেকেই কর্মহীন হয়ে পড়েছে। এর মাঝে ঘূর্ণিঝড় আম্পান এসে ‘মরার উপর খাঁড়ার ঘা’ চেপে ধরেছে এসব কর্মহীন অসহায় মানুষদের।

ক্ষতিগ্রস্তদের অভিযোগ, সরকারি সাহায্য ক্ষতিগ্রস্ত সবাই পাচ্ছে না। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা যে তালিকা তৈরি করেছেন, তাতে আত্মীয়স্বজন ও কাছের লোকজনকে প্রাধান্য দিয়েছেন। ফলে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক সরকারি সাহায্যের তালিকায় নেই।

যশোর সদর উপজেলার মাহিদিয়া এলাকার রিকশা চালক মহাসিন হোসেন বলেন, ‘আমার প্রায় ৩০ বছর জীবনে ধরে এমন ঝড় দেখেনি। এবার ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড় হয়েছে। আমার সব শেষ করে দিয়েছে। এমন ভয়ঙ্কও ঝড় ১৯৮৮ সালের ঝড়কেও হার মানিয়েছে।’

 

তিনি আরও বলেন, ‘পরিবার-পরিজন নিয়ে চরম বিপদে আছেন। কিন্তু এখনো তাদের সরকারি খাদ্য ও আর্থিক সহায়তা মেলেনি। ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা থেকে তাদের নাম বাদ পড়েছে। পরে যোগাযোগ করেও তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করতে পারেননি।’

সদর উপজেলার পুলেরহাট এলাকার ফুলিয়া বেগম জানান, ঝড়ে বড় একটি গাছ তার বসতবাড়ি মাঝা মাঝি ছাপা পড়ে। ভাগ্যক্রমে তারা বেঁচে গেলেও তার একটি গরু, বসতবাড়ি, জীবিকার একমাত্র বাহন রিকশাটি ভেঙে যায়।

তিনি আরও বলেন, ‘করোনায় কোনো আয় রোজগার না থাকার ফলে ঘরবাড়ি মেরামত করতে পারেনি। পত্র পত্রিকায় শুনেছি ক্ষতিগ্রস্তদের টিন ও টাকা দিচ্ছে। একটাকাও পেলাম না। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ভোটার কার্ড নিয়েছিল। ২১ দিন পার হলেও এখনো কিছু পেলাম না।’

এ বিষয়ে চাঁচড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল আজিজ বিশ্বাস বলেন, ‘আমার ইউনিয়নে ক্ষতিগ্রস্তদের সংখ্যা বেশি। ঝড়ের এত দিন পার হলেও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো সাহয্য সহযোগিতা দেওয়া হয়নি। আম্পানে কারণে সরকার কোনো সাহয্য সহযোগিতা দেয়নি, তাই ক্ষতিগ্রস্তদের কোনো সহযোগিতাও করা হয়নি।’

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা সানোয়ার হোসেন বলেন, ‘আম্পানের আঘাতে যশোরের ৮টি উপজেলার ৯৩টি ইউনিয়ন এলাকায় কম বেশি ক্ষতি হয়েছে। গাছ উপড়ে পড়ে যশোরের ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। অনেক এলাকায় ঘর ভেঙে পড়েছে। কিছু এলাকায় ঘরের আংশিক ক্ষতি হয়েছে। সব মিলিয়ে যশোরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাড়ে ৫ লক্ষাধিক লোক। আম্পানে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে আট উপজেলায় টিন বিতরণ চলছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের ভেঙে যায় ঘর ঠিক করার জন্য প্রায় ১ হাজার ৪০০ বান টিন বরাদ্দ হয়েছে। এছাড়া খাদ্য সহায়তা হিসেবে ১০০ মেট্রিকটন চালও বিতরণ হচ্ছে। সরকারের সাহায্যের অপ্রতুলতার কারণে অনেক পরিবার বঞ্চিত হচ্ছে। তাই আগে ত্রাণ সহায়তা বাড়ানো জরুরি। প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত কেউ বাদ থাকবে না। প্রয়োজনে তালিকায় আরও নতুন নাম অন্তর্ভুক্ত করা হবে।’

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শফিউল আরিফ বলেন, ‘ঝড়ের পর ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করা হয়েছে। এরই মধ্যে ১৩০০ বান টিন বিতরণ করা হয়েছে। প্রতিটি টিনের বানের সঙ্গে ৩ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ঝড়ে যারা প্রাণ হারিয়েছে তাদের প্রত্যেক পরিবারের মাঝে ২০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন সেক্টরে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা প্রস্তুত করে এসব ক্ষতি পুষিয়ে নিতে আমরা স্ব স্ব মন্ত্রণালয়ের দফতরে চাহিদা পাঠিয়েছি।’