১৬ কোটি মানুষের জন্য নেই সরকারি কোনও ‘আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্স’

প্রকাশিত: ১২:৪৯ পূর্বাহ্ণ, জুন ৪, ২০২০

দেশে লাইফ সাপোর্ট সুবিধাসহ সরকারি কোনও মোবাইল নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র বা ‘আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্স’ নেই। সাতটি হাইটেক কার্ডিয়াক অ্যাম্বুলেন্স থাকলেও সেগুলোকে পুরোপুরি আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্স বলা যায় না। বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতালে ও ব্যক্তি মালিকানাধীন কয়েকটি আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্স থাকলেও সেগুলোর খরচ অনেক বেশি। এছাড়া বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্সের সেবা পেতে হলে রোগীকে ওই হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার চুক্তি করতে হয়।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত শ্বাসকষ্টের রোগীকে মানসম্পন্ন অ্যাম্বুলেন্স সেবা সঠিক সময় দিতে পারলে তার জীবনের ঝুঁকি অনেকটা কমে যায়। তাছাড়া দেশের হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ বেডের সংখ্যা কম থাকায় রোগীদের এক জেলা থেকে আরেক জেলায় নিতে হচ্ছে। এজন্যও আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্স প্রয়োজন।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্রের ভাষ্য, দেশে আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্স থাকা দরকার। কখনও কখনও মুমূর্ষু রোগীদের লাইফ সাপোর্ট দিয়ে স্থানান্তর করতে হয়। মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আরও দুটি হাইটেক কার্ডিয়াক অ্যাম্বুলেন্স কেনার পরিকল্পনা নিয়েছে। তবে এ মুহূর্তে আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্সের বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নেই।

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গত ১৫ এপ্রিল কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান সিলেটের এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মঈন উদ্দিন। এর আগে গত ৫ এপ্রিল তার শরীরে করোনা পজিটিভ ধরা পড়ে। শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে ৭ এপ্রিল তাকে সিলেটের শহীদ শামসুদ্দিন হাসপাতালের আইসিইউতে নেওয়া হয়। অবস্থার কোনও উন্নতি না হওয়ায় ৮ এপ্রিল সেখান থেকে পরিবারের ইচ্ছায় চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকার কুর্মিটোলা হাসপাতালে আনা হয়। তবে তাকে ঢাকা পর্যন্ত নিয়ে আসতে পরিবারকে বেগ পেতে হয়। তার পরিবারের পক্ষ থেকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সের দাবি করা হলেও তার ব্যবস্থা করা যায়নি। পরবর্তী সময়ে পরিবারের উদ্যোগে একটি বেসরকারি আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্সে তাকে ঢাকা নিয়ে আসা হয়।

চিকিৎসক মঈন উদ্দিনের পরিবারের মতো অনেকেই গুরুতর অসুস্থ রোগী স্থানান্তর নিয়ে জটিলতায় পড়েন। কারণ, দেশে সরকারি কোনও আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্স নেই, আর বেসরকারি যা রয়েছে তা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে।

আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্সে যেসব সুবিধা থাকে

মোবাইল আইসিইউ বা আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্স হলো একটি সুসজ্জিত নিবিড় পরিচর্যা অ্যাম্বুলেন্স। কোনও হাসপাতালের আইসিইউতে যা যা থাকে, মোবাইল আইসিইউ বা আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্সেও সেসব সুবিধা থাকে। এই অ্যাম্বুলেন্স যাত্রাপথে রোগীকে সবরকম সুবিধা দিতে সক্ষম। এটির ভেতরে চিকিৎসক, উচ্চ প্রশিক্ষিত প্যারামেডিক্স ও নার্সদের জন্য জায়গা রয়েছে। মোট কথা, এটি অত্যাধুনিক অ্যাডভান্সড লাইফ সাপোর্ট (এএলএস) সংযুক্ত মেডিক্যাল যন্ত্রপাতি দিয়ে সুসজ্জিত। ভেতরে নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রা ও আলো থাকে।

দেশে নেই কোনও সরকারি আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্স

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশে এই মুহূর্তে সরকারি কোনও আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্স নেই। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, দেশে সরকারি সাতটি হাইটেক কার্ডিয়াক অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে। এগুলো তুরস্ক থেকে আনা হয়েছে। তবে এগুলো আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্স নয়। এরকম আরও দুটি অ্যাম্বুলেন্স আনার প্রস্তাব রয়েছে। এই সাতটি অ্যাম্বুলেন্স দেশের বড় মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলোকে দেওয়া হয়েছে বলেও জানিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

ঢাকা মহানগর অ্যাম্বুলেন্স মালিক সমিতির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে বেসরকারি আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে মাত্র ১৬টি। এগুলোতে ভেন্টিলেশনসহ সব ধরনের সুবিধা রয়েছে বলে দাবি করেছে সংগঠনটি। এরমধ্যে ঢাকা সিটিতে ১২টি, চট্টগ্রামে দুটি, খুলনা ও সিলেটে একটি করে বেসরকারি আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে।

বেসরকারি দুটি হাসপাতালে আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্স থাকলেও তা পেতে শর্ত পূরণ করতে হয়। স্কয়ার হাসপাতাল, ল্যাব এইড হাসপাতাল, ইউনাইটেড হাসপাতাল ও এভার কেয়ার (সাবেক অ্যাপোলো)—এই চারটি হাসপাতালের মধ্যে কেবল ইউনাইটেড ও এভার কেয়ার হাসপাতালের আইসিইউ সুবিধাসহ অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে। এরমধ্যে ইউনাইটেড হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স ঢাকার বাইরে রোগী বহন করে না। কেবল ঢাকা সিটিতে তারা রোগী বহন করে বলে হাসপাতালটির কাস্টমার কেয়ার বিভাগ থেকে জানানো হয়েছে। অপরদিকে এভার কেয়ার হাসপাতালের আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্স ঢাকার বাইরে গেলেও তাদের শর্ত হচ্ছে—রোগীকে তাদের হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে। তাহলেই তাদের আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্সের সেবা পাওয়া যাবে।

সোমবার (১ জুন) এভার কেয়ার হাসপাতালে রোগী সেজে আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্স সেবা পেতে চাইলে একজন ফোন অপারেটর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রোগী আমাদের হাসপাতালে নিয়ে এলে আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্স সেবা পাবেন। সেক্ষেত্রে প্রতি কিলোমিটার ৮৫ টাকা করে ভাড়া।’ অপরদিকে ইউনাইটেডের কাস্টমার কেয়ার থেকে জানানো হয়, ‘তারা ঢাকা বাইরে আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্স সেবা দেয় না।’

বেসরকারি আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্সের খরচ বেশি

বেসরকারি আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্সের সেবা পেতে খরচ অনেক বেশি। ঢাকার ভেতরে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্সের ভাড়া ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা, ঢাকার বাইরে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা। রোগীকে আনা-নেওয়ার সময় এসব অ্যাম্বুলেন্সে একজন চিকিৎসক ও একজন নার্সের সেবা পাওয়া যাবে। এত বেশি ভাড়া নেওয়ার বিষয়ে ঢাকা মহানগর অ্যাম্বুলেন্স মালিক সমিতির সভাপতি আলমগীর হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্সগুলোতে একজন নার্স ও চিকিৎসক দিয়ে থাকি। তাদের টাকা দিতে হয়। ঢাকার বাইরে একজন চিকিৎসক পাঠালে তাকে ন্যূনতম ৮/১০ হাজার টাকা দিতে হয়। নার্সকে দিতে হয় পাঁচ হাজার টাকা। তাই খরচ একটু বেশি পড়ে।’

সরকারি-বেসরকারি সাধারণ অ্যাম্বুলেন্সের সংখ্যা

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে নৌ-অ্যাম্বুলেন্সসহ প্রায় এক হাজারের বেশি সরকারি অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে। দেশের ৪৯২টি উপজেলার সব স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে। তবে কিছু অ্যাম্বুলেন্স পুরনো হওয়ায় ব্যবহারের উপযোগিতা হারিয়েছে। মন্ত্রণালয় থেকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অ্যাম্বুলেন্সগুলোর সর্বশেষ অবস্থা জানতে চিঠি দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বর্তমানে দেশের সব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অ্যাম্বুলেন্স থাকলেও কয়েকটি উপজেলার অ্যাম্বুলেন্স নষ্ট রয়েছে। এছাড়া, দেশের সরকারি জেলা হাসপাতালে দেড় শতাধিক, মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে অর্ধশতাধিক, স্নাতকোত্তর ও বিশেষায়িত হাসপাতালে ১৬টির বেশি সরকারি অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে। এছাড়া, দেশে ২০টির মতো নৌ অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে, যেগুলো রোগীদের সেবা দিয়ে থাকে। তবে দেশে বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে প্রায় ৮ হাজার। যদিও এগুলোর সব অ্যাম্বুলেন্স হিসেবে নিবন্ধিত না। কিছু মাইক্রোবাসকে মোডিফাই করে অ্যাম্বুলেন্স বানানো হয়েছে।

করোনা রোগীদের স্থানান্তরে প্রয়োজন মোবাইল আইসিইউ

কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোর মধ্যে অন্যতম কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল। এই হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) সকাল থেকে কাজ করেন বিভাগীয় প্রধান সহকারী অধ্যাপক ডা. শাহজাদ হোসেন মাসুম। মোবাইল আইসিইউ’র প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যদি কোনও গুরুতর অসুস্থ ও শ্বাসকষ্টের রোগীকে দূরের পথে নিতে হয়, অথবা আইসিইউতে রাখতে হবে, কিন্তু আইসিইউ সুবিধার হাসপাতাল অনেক দূরে, তাহলে তাকে আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্সে স্থানান্তর করতে হবে। এছাড়া এক আইসিইউ থেকে আরেক আইসিইউতে নিতে হলেও রোগীকে আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্সে বহন করতে হবে।’

সারাদেশে কোভিড ডেডিকেটেড অ্যাম্বুলেন্স

গত ১ জুন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্যমতে, ঢাকা সহ সারা দেশের জেলা শহরে অন্তত ৬৫টি অ্যাম্বুলেন্সকে কোভিড ডেডিকেটেড করা হয়েছে। এসব অ্যাম্বুলেন্সের চালক ও হাসপাতালের ফোন নম্বর জেলাগুলোর নাগরিকদের দেওয়া হয়েছে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ও মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক হাবিবুর রহমান খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের প্রকৃত অর্থে কোনও আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্স নেই। তবে হাইটেক কার্ডিয়াক অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে। এগুলোতেও আইসিইউ’র কিছু সুবিধা পাওয়া যায়। এরকম সাতটি হাইটেক কার্ডিয়াক অ্যাম্বুলেন্স আমাদের রয়েছে। আরও দুটি আনার প্রস্তাব রয়েছে।’

দেশে প্রয়োজনের তুলনায় অ্যাম্বুলেন্সের সংখ্যা কেমন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রত্যেক উপজেলায় অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে, জেলা হাসপাতালে রয়েছে। এছাড়াও মেডিক্যাল কলেজগুলোতেও অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে। তবে উপজেলা পর্যায়ে আমরা দুটি করে অ্যাম্বুলেন্সের প্রয়োজনীয়তার কথা ভাবছি। ধীরে ধীরে সেগুলো করা হবে।’