প্রকাশিত: ৪:৩৬ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ২৪, ২০২১

এখন চলছে বাংলা বৈশাখ মাস। এই মাস এলেই ছোট বেলায় খাওয়া একটি ফলের কথা ভীষণ মনে পড়ে। আর সেটি হচ্ছে খৈ ফল।


আমাদের গ্রামটি ভৈরব নদের তীরে অবস্থিত। এই সময় ভৈরব নদে পানি শুকিয়ে যেত। আর জেলেরা মাছ ধরার জন্য কচুরিপানা ( আঞ্চলিক ভাষায় বলে পট) দিয়ে বাঁধের মতো করতো। আমরা কৈশোরে ওই কচুরিপানার বাঁধের উপর দিয়ে হেটে পার হয়ে যশোর ঝিনাইদহ সড়কে খৈ গাছ থেকে খৈ ফল পাড়ার জন্য দল বেধে যেতাম। নাহলে আরো এক বা দেড় কিলোমিটার হাঁটতে হতো। পুরাতন খয়েরতলা ( ক্যান্টনমেন্ট বাজার) বাজার থেকে উত্তরে সিগনাল সেন্টার পর্যন্ত রাস্তার দু’ধারে অনেক বড় বড় খৈ ফল গাছ ছিল। সেখানে এখনো খৈ গাছ আছে। আজ থেকে ১৫-২০ বছর আগের কথা। আমরা গাছে ওঠে কিংবা ঢিল ছুড়ে বা বাঁশের কঞ্চির মাথায় আংটা মতো বানিয়ে তাই দিয়ে খৈ ফল গাছ থেকে পাড়তাম। ফলটি দীর্ঘদিন খাইনি। কিন্তু এর স্বাদ যেন এখনো মুখে লেগে আছে।
এই ফলটি দেখতে অনেকটা জিলাপির মতো বলে এ ফলকে জিলাপি ফলও বলা হয়। অঞ্চলভেদে অনেকেই একে খইয়া বাবলা বা দক্ষিণী বাবুলও বলে থাকে। খৈ ফলের বৈজ্ঞানিক নাম-Pithecellobium dulce ( পিথেসেলোবিয়াম ডুলসি)। গ্রিক পিথেসেলোবিয়াম এর অর্থ ‘বানরের ফল’ আর লাতিন ডুলসি মানে মিষ্টি। এর স্পেনীয় নাম গুয়ামুশিল। হিন্দিতে বলে গঙ্গা ইমলি বা গঙ্গা তেঁতুল। ইংরেজিতে এর নাম মাদ্রাজ থর্ন। ফিলিপাইনে একে বলে ম্যানিলা ট্যামারিন্ড। খৈ শিম পরিবারের উদ্ভিদ। এর আদি নিবাস মেক্সিকো ও তার পাশের দেশগুলো।
স্পেনিশ ও পর্তুগিজরা একে ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইনে নিয়ে আসে। এরপর এটি নানা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ৬-৭ সাত ফুট সমান উঁচু হলেও গাছে ফুল ধরা শুরু হয়। ৫-৬ বছরে ৩০-৫০ ফুট হতে পারে। এই গাছ লাগানো পর আর কোনো যত্ন নিতে হয় না। গাছ কেটে ফেললে এর গোড়া থেকে নতুন গাছ জন্মায়। গবাদি পশুরা মুড়ো করে খেয়ে ফেললেও এই গাছের তেমন ক্ষতি হয় না। খই বাবলা গাছ মরু বালিতে কাদামাটিতে এমনকি লবণাক্ত মাটিতেও বহাল তবিয়তে টিকে থাকে। খইবাবলার কাণ্ড দেখতে সুন্দর ও পেঁচানো। খই বাবলা চারটি উপপত্র যুক্ত। দেখতে অনেকটা কাঞ্চনের পাতার মতো পাতার গোড়ার দিকে সাধারণত একজোড়া কাঁটা থাকে। পুরনো পাতা ঝরে দ্রুত নতুন পাতা গজায় বলে একে চিরসবুজ গাছ মনে করা হয়। খৈ গাছের ফুল দেখতে পাউডারপাফের মতো। প্রতিটি ফলে ৫-১০টি বীজ থাকে। এ গাছের ফুল আকৃতিতে বেশ ছোট। এর ফুল ফাল্গুনে ফোটে এবং চৈত্র-বৈশাখ মাসে এই ফল পাকে। এই ফলের বীজ থেকে সহজে চারা হয়। তবে নতুন গাছ সৃষ্টির জন্য এর শাখা কলমও ব্যবহার করা যায়।
এন্থোসায়ানিন রসায়নের উপস্থিতির কারণে খৈ ফল পুষ্ট হলে লাল হয়ে যায়। এর শাঁস পুরু, নরম, মিষ্টি ও কইসট্যা এই ফল ফেটে গিয়ে কালো বীজের চারিদিকে খই সদৃশ্য হলুদাভ সাদা মাংস বেরিয়ে পড়ে। এই ফল কাঁচা অবস্থায় সবুজ থাকে কিন্তু পাকলে এর খোসা টকটকে লাল হয়ে ফেটে যায়।
দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশে এই ফল ঝুড়ি ভরে বাজারে বিক্রি হয়। ব্রাজিল ও মেক্সিকোতে খৈ ফল থেকে অনেক ধরনের নিত্য পানীয় তৈরি হয়। কাটা থাকার কারণে সর্বভুক ছাগল ছাড়া অন্য প্রাণীরা এর থেকে দূরে থাকে। দক্ষিণ আমেরিকায় এই গাছের ফলপাতা গরু,ছাগলকে, ঘোড়া, মহিষের পছন্দের খাবার। এই গাছের বাকলে অগ্নি প্রতিরোধক ট্যানিন থাকে। এর বাকল থেকে ট্যানিন সংগ্রহ করে চামড়া কারখানায় ব্যবহার করা হয়। এই গাছের বাকল আমাশয়, ডাইরিয়া ও যক্ষা রোগ নিরাময় করে। এর বীজ আলসার ও কফ নির্মূল করে। পাতা পিত্তাশয়ের রোগ নিরাময়ে ব্যবহৃত হয়। এর তক্তা দিয়ে ভালো প্যাকিং বক্স তৈরি হয়।
আমাদের দেশে এ ফল এমনিতেই হয়ে থাকে। তবে অনেকেই শখ করে বাড়ির চারদিকে, রাস্তার পাশে এ ফলের গাছ লাগিয়ে থাকেন। যশোর, খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী ও খুলনায় যথেষ্ট পরিমাণ এই ফলের গাছ দেখা যায়।